গত ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে টেলিভিশন চ্যানেলে কর্মরত বিনোদন সাংবাদিকদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে 'টেলিভিশন এন্টারটেইনমেন্ট জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ' (টেজাব) আত্মপ্রকাশ করেন। সংগঠনটি এমন একটা সময় আত্মপ্রকাশ করে যখন দেশের বিনোদন জগতের হোয়াটসআপ কাণ্ড নিয়ে চলছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যপক আলোচনা-সমালোচনা।
এসব কারণেই এই সংগঠন গঠন হবার পর অনেকেই সমালচনা করেছেন , সংগঠনটি নিয়ে। অনেক বিনোদন সংবাদকর্মী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ইংগীতপূর্ণ পোস্টও দিয়েছেন। কেউ কেউ সরাসরি অভিযোগ তুলেছে 'আলো আসবেই' হোয়াটসআপ গ্রুপের জন্য কাজ করতেই এই সংগঠন। আবার কেউ অভিযোগ করেছেন, সিন্ডিকেট করে অর্থ আদায়ের কথাও। একটি ওটিটির জন্য কাজ করার অভিযোগও রয়েছে এদের বিরুদ্ধে।
অর্নব্রিং এবং মোলারের মতে, সাংবাদিকরা মতাদর্শগতভাবে বিভক্ত থাকতে পারেন, যেমন পেশাদারিত্ব, স্বাধীনতা, বা নৈতিকতা সংক্রান্ত ইস্যুতে। এসব বিভাজন তাদের নতুন সংগঠন তৈরি করতে উৎসাহিত করতে পারে, যা তাদের নিজস্ব মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে। এই দুই গবেষকের মতে, কখনও কখনও বিদ্যমান সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা সংকট সদস্যদের নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে প্ররোচিত করতে পারে।
এই সংজ্ঞার উপর দাঁড়িয়ে আমরাও বোঝার চেষ্টা করেছি, ১৯৬৮ সালে তৈরি হওয়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির উপর তাদের কোন অনাস্থা আছে কিনা? আমরা যোগাযোগ করি নতুন এই সংগঠনটির সভাপতি চ্যানেল ২৪-এর সাংবাদিক নাজমুল আলম রানার সাথে। তার কাছে সংগঠনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য জানতে চাওয়া হয়।
তিনি তখন বলেন, এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য হলো, টেলিভিশনের প্রকৃত সাংবাদিকদের কল্যাণে কাজ করা। কাজ করতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই ক্রাইসিস ফেস করি। তখন সবাই বলে, আপনারা যদি একটা সংগঠনের ব্যানারে কথা বলেন, তাহলে এটা সমাধান অনেক সহজ।
পাশাপাশি তিনি দাবি করেন টেলিভিশনে বিনোদন সাংবাদিকতা অবহেলিত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই চিত্রের পরিবর্তন করতে চাই। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে এখন প্রতিদিন ৩০ মিনিট বিনোদন ও লাইফস্টাইল নিউজ হয়। যমুনা টিভিতেও হয়। অন্য কয়েকটি চ্যানেলে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান হয়।
হ্যারিসন জে ২০০৬ সালে তার প্রকাশিত একটা বইয়ে দেখিয়েছিলেন কেন দূর্নীতিবাজ ও বিতর্কিত কাউকে সংগঠনে যুক্ত করা হয়। হ্যারিসনের মতে, নতুন সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে কখনও কখনও দূর্নীতিবাজ ও অসৎ সাংবাদিকদের বড় পদে বসানো হয় মূলত তাদের শক্তিশালী প্রভাব, নেটওয়ার্ক এবং অর্থ সংগ্রহের দক্ষতার জন্য। মিডিয়া জগতে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যক্তিরা নতুন সংগঠনকে দ্রুত পরিচিতি ও সমর্থন পেতে সহায়তা করে। এছাড়া, তারা সংগঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন এবং সম্পদ আনতে সক্ষম হন, যা অন্যদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। প্রায়ই সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের কাঠামোতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, যেখানে এই ধরনের সাংবাদিকরা সহজেই মানিয়ে নিতে পারেন এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেন।
এই সংগঠনের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ রয়েছে।
একাত্তর টিভির বুলবুল আহমেদ জয় নামে বিতর্কিত সংবাদকর্মীকেই তারা সাধারণ সম্পাদক করেছেন। যার বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র প্রচারের নামে টাকা খাওয়া থেকে শুরু করে নানা রকম অনৈতিক কর্মকান্ডের অভিযোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টেজাবের সভাপতি রানা দাবি করেন, তার সাথে বুলবুলের সাথে তার এক যুগের বেশি সময় ধরে পরিচয়। রানা জানান, বুলবুলের ফ্ল্যাট দুইটা ঢাকায়। যা সে লোন নিয়ে এবং চাকরি করেই করেছে। এছাড়াও বুলবুল প্রাইমার্ক, ওয়ালমার্ট, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বিভিন্ন প্রজেক্টেও সে কনসালটেন্সি করে।
তবে তিনি এ ও বলেন, গঠনতন্ত্রের ধারা ১৩.৮ এ রয়েছে টেজাবের কোন সদস্যর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হলে তার সদস্যপদ বাতিল হবে। জয় যদি দুর্নীতি করে আর সেটা আইনগতভাবে প্রমাণিত হয়, অবশ্যই জয় কিংবা যে কাউকে সংগঠনে রাখা হবে না।
বাংলাদেশ মিডিয়া মনিটরের পক্ষ থেকে রানার কাছে জানতে চাওয়া হয়, একটি ওটিটির জন্য কাজ করবেন বলে আপনারা এই সংগঠন করেছেন বলে বেশ কিছু সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন৷ এটার ব্যখ্যা কি? যার জবাবে তিনি বলেন, "আপনি হয়তো চরকির কথা বলছেন। সত্যি বলতে একদমই তা না। আমরা শুধু চরকিকে না, চরকির পাশাপাশি হইচই, বঙ্গ, লাইভ টেকনোলজি, স্টার সিনেপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক মেজবা, লায়ন সিনেমা হলের মালিক, মধুমিতা হলের মালিক নওশাদ ভাইকেও বলেছিলাম। "
"কিন্তু ব্যস্ত দিন থাকায় কেউ আসেননি, ফোনে শুভকামনা জানিয়েছেন। অনুষ্ঠানে শুধু এসেছেন চরকির দুজন। তারা আসার কারণ সম্ভবত প্রতীক আকবর। যেহেতু সে আমাদের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, এবং আমাদের বন্ধু মানুষ। "
টেলিভিশন সাংবাদিকদের সিন্ডিকেটকেই কমিটিতে রুপান্তর করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমন অভিযোগের কোন প্রমাণ নেই। আমরা যারা প্রথমসারির চ্যানেল, মাসশেষে আমরা বেতন পাই। ক্রাইসিস হলে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে চলি। হারাম টাকা আমরা খাই না।
এছাড়া সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, টেলিভিশনকে যদি কোন প্রযোজক-পরিচালক কিংবা নায়ক-নায়িকা মুল্যানয় করে, তখন যদু-মধু-রাম-শ্যাম পত্রিকা-অনলাইন-ইউটিউবাররা বলে, ওরা সিন্ডিকেট।
জুডিথ লিচেনবার্গ ২০০৯ সালে তার একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন, টেলিভিশন সাংবাদিকরা প্রায়ই তাদের পেশাগত দক্ষতা এবং মিডিয়া পরিবেশে তাদের ভূমিকার প্রতি একটি উচ্চ আত্মমর্যাদাবোধ অনুভব করেন। এটি তাদের মাঝে কখনও কখনও ইগো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যা তাদের নিজের স্বতন্ত্র সংগঠন গঠনের ইচ্ছাকে প্রভাবিত করতে পারে। লিচেনবার্গের এই কথার সাথে রানার অনলাইন-ইউটিউবারদের নিয়ে দেয়া বক্তব্যের বেশ মিল পাওয়া যায়।
এদিকে এই কমিটিতে চার জন চ্যানেল ২৪ এর সংবাদকর্মী থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে, তিনি সরাসরি সেটা না করে দিয়ে বলেন, দুই প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ ১৩ জনের কমিটিতে চ্যানেল২৪ রয়েছেন ৩ জন।
এই সংগঠনের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ রয়েছে যে, সকল টেলিভিশনের বিনোদন সাংবাদিকদেরকেও তারা একই সংগঠনের অধীনে আনতে পারেনি।
এসকল বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য আমরা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির (বাচসাস) সাধারণ সম্পাদক রিমন মাহফুজের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও যোগাযোগ করতে পারিনি।
Two Comments