পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা—রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, ও খাগড়াছড়ি—দীর্ঘদিন ধরেই সংঘাতময় পরিস্থিতিতে রয়েছে। মূলত আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে জমি ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে বিরোধের ফলে এই অঞ্চলে সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যেই সাংবাদিকতা আরও কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় সাংবাদিকরা সামরিক বাহিনী, আদিবাসী গোষ্ঠী ও বাঙালি জনগোষ্ঠী থেকে প্রতিনিয়ত চাপে রয়েছেন, যার ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষত বাঙালি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের তথ্য উঠে এসেছে। আমাদের কাছে থাকা নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে যে, বাঙালি সাংবাদিকরা অনেক সময় সেনাবাহিনীর বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, যেখানে সেনা সদস্যরা সাংবাদিকদের নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন। নিরাপত্তার কারণে এই প্রমাণগুলো প্রকাশ করা সম্ভব নয়, তবে এই সেন্সরশিপের প্রবণতা স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক তৈরি করেছে।
অন্যদিকে, আদিবাসী সাংবাদিকরাও ভিন্ন ধরনের হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। একজন আদিবাসী সাংবাদিককে সম্প্রতি বাঙালি জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সরাসরি হুমকি দেয়ার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই হুমকির কারণে ওই সাংবাদিক স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশ করতে পারছেন না এবং তার কাজের ওপরও বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, সাংবাদিকরা এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন, যেখানে সত্য প্রকাশ করতে গেলে নিজ জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে হতে পারে, এবং এর ফলে তাদেরকে বহুমুখী বিপদের মুখোমুখি হতে হয়।
পার্বত্য এলাকায় সাংবাদিকদের মধ্যে আরও একটি বড় সমস্যা হল সেলফ সেন্সরশিপ। অনেকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কিংবা স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর চাপে পড়ে স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন করতে পারছেন না। সাংবাদিকরা ভয়ে নিজেদের লেখার ওপর সেন্সর আরোপ করছেন, যাতে তাদের জীবন বা কর্মক্ষেত্র ঝুঁকির মুখে না পড়ে। এমন এক পরিস্থিতিতে, যেখানে সত্য ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে সাংবাদিকরা আত্মরক্ষার জন্য সত্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকছেন।
সাংবাদিকতার এই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় সাংবাদিকরা যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারেন, তবে এই অঞ্চলের প্রকৃত পরিস্থিতি কখনোই জনসম্মুখে আসবে না, যা আরও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে সাংবাদিকরা নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন এবং প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে পারেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতা শুধুমাত্র একটি পেশা নয়, বরং একটি সাহসিকতার পরীক্ষা। স্থানীয় সাংবাদিকদের ভয় ও হুমকির মধ্যেও সত্য তুলে ধরার চেষ্টা চলমান, তবে তাদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া এই সংগ্রাম সফল হবে না। সাংবাদিকতা যে শুধু সংবাদ পরিবেশন নয়, বরং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটি বর্তমান পরিস্থিতির মাধ্যমে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে।
Two Comments