। ধ্রুব আলো: ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলা ট্রিবিউন 'পাকিস্তানের স্কুল-কলেজে একাত্তর ও বাংলাদেশ নিয়ে কী পড়ানো হয়' শিরোনামে একটা লেখা প্রকাশ করে। এরপর একটি ভিডিও স্টোরিও প্রকাশ করেন। লেখা স্টোরির কোথাও রিপোর্টারের নাম বা কোথা থেকে নেয়া হয়েছে এমন কোন ক্রেডিট দেয়া ছিল না। আর ভিডিও স্টোরিতে যিনি উপস্থাপিকা ছিলেন তার নাম ছিল, রুবাইয়া সুলতানা। তিনিই এই প্রতিবেদন লিখেছেন কী-না সেটাও কোথাও উল্লেখ নেই। এই বিষয়ে আমরা বাংলা ট্রিবিউনের বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি এবং স্টোরিটির লেখক কে সেই বিষয়ে জানার চেষ্টা করেছি। যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা কেউই এই স্টোরির লেখক কে সেটি জানেন না৷ কেউ কেউ ইনিশিয়াল দেখে নাম নিশ্চিত হলেও সেটি এড়িয়ে গেছেন।
আমরা প্রতিবেদনের কাঠামো ও বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতে চাই। এই প্রতিবেদনটি পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থায় ও বিশেষত দেশটির পাঠ্য বইগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগকে কেন্দ্রিক। এখানে পাকিস্তানের স্কুল এবং কলেজগুলোতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে ন্যারেটিভ (দৃষ্টিকোন) বা উপস্থাপনা রয়েছে, তা বাংলাদেশের বীরত্ব ও ইতিহাসের প্রতি বিরূপ বলে দাবি করা হয়েছে। তাদের পাঠ্যপুস্তকে বলা হয়েছে, ৭১-এ মূলত যুদ্ধ হয়েছিলো পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের! এছাড়া প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে যে পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা তরুণদের ভুল ইতিহাস শিখিয়ে বিভ্রান্ত করছে।
লেখাটি স্পষ্টতই শক্তিশালী বর্ণনা ও ধ্বংসাত্মক শব্দ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে, যা পাকিস্তানকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার একটি প্রয়াস হিসেবে ধরা যায়। যেমন, '
ইতিহাস বিকৃতি' বা '
ভুল তথ্য প্রচার' ধরনের শব্দের ব্যবহার সচেতনভাবে করা হয়েছে। এটি পাঠকের মনে একটি মেরুকৃত ধারণা গড়ে তুলতে সাহায্য করে যে, পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি বিকৃত ন্যারেটিভ তৈরি করছে।
স্টোরির ভূমিকায় জুলাই অভ্যুত্থানকে অস্বীকারের চেষ্টা: স্টোরির ভূমিকায় প্রথম চার লাইনে বলা হয়েছে,"বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের জেরে ক্ষমতার কেন্দ্রে যে নাটকীয় পালাবদল হয়েছে, তাকে দেশের অনেকেই 'দ্বিতীয় স্বাধীনতা' বলে বর্ণনা করছেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে পাকিস্তানেও এই ঘটনাপ্রবাহকে অনেকেই স্বাগত জানাচ্ছেন। গত মাসে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে সে দেশের মাটিতে বিজয় মিছিল পর্যন্ত হয়েছে, যা এক অতি বিরল ঘটনা!" এখানে প্রথমে
"ছাত্র-জনতার আন্দোলনে" শব্দগুলো ব্যবহার করে পুরো জুলাই অভ্যুত্থানকে একটি নিছক আন্দোলন বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে৷ সেই সঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রের পরিবর্তনকে "
নাটকীয়" আখ্যা দিয়ে পতিত স্বৈরশাসকের দেশত্যাগকে কৌশলে মহিমান্বিত করার চেষ্টা ও বিগত স্বৈরশাসনকে প্রশ্নের বাইরে রাখাসহ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া এই অভ্যুত্থানের পর পাকিস্তানের মাটিতে
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে বিজয় মিছিলের ঘটনা উল্লেখ করে জুলাই অভ্যুত্থানকে বিতর্কিত করাসহ এই অভ্যুত্থানে পাকিস্তানের হাত আছে বা লাভ আছে বলে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
লেখকের নামহীনতা: কৌশলগত নিরপেক্ষতা নাকি রাজনৈতিক চাপ?
প্রথমেই, লেখকের নাম উল্লেখ না থাকার বিষয়টি লক্ষণীয়। সংবাদমাধ্যমে লেখকের নাম গোপন রাখা সাধারণত দুটি কারণে ঘটে:
- নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা: এটি হতে পারে এমন পরিস্থিতিতে যেখানে লেখককে রাজনৈতিক চাপ বা ব্যক্তিগত হুমকি থেকে রক্ষা করার প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক চাপ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সংবাদমাধ্যমে এমন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে, এটি রাজনৈতিক সতর্কতা বা প্রচারণার অংশ হতে পারে।
- বিষয়বস্তুর সংবেদনশীলতা: ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে আলোচনা করা অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়। এখানে, লেখকহীনতা লেখার নিরপেক্ষতা বা পক্ষপাতের ইঙ্গিত দেয়। যদি পাঠকরা জানতেন লেখক সরকারের বা রাজনৈতিক দলসমর্থিত, তবে তা প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা কমাতে পারত।
প্রোপাগাণ্ডা টেকনিক বিশ্লেষণ: শত্রু চিত্রায়ন ও জাতীয়তাবাদ
- শত্রুকে অমানবিক করা: পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের বিকৃতি তুলে ধরে লেখাটি পাকিস্তানের প্রতি নেতিবাচক চিত্র সৃষ্টি করে। পাকিস্তানকে শত্রু হিসেবে চিত্রিত করা হয়, যারা ইতিহাসের বিকৃতি ঘটায় এবং নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরে। এটি বাংলাদেশের পাঠক সমাজের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবকে আরো সুসংহত করতে পারে।
- জাতীয় পরিচয়ের পুনর্গঠন: প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করার একটি প্রচেষ্টা। পাকিস্তানের “ভুল” ইতিহাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি জাতীয় পরিচয়কে পুনরায় প্রমাণ করা হয়। এটা আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেদের অবস্থানকেও জোরদার করে।
ভারতের ভূমিকায় সফট প্রোপাগাণ্ডা: ভারত কিভাবে যুক্ত হতে পারে?
ভারতীয় সংযোগ না থাকলেও, ভারতের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা নিয়ে এই প্রতিবেদনে কোনো সমালোচনা বা বিতর্কিত প্রসঙ্গ তোলা হয়নি। তবে, ভারতের ভূমিকায় সফট প্রোপাগাণ্ডার ইঙ্গিত রয়েছে:
- নির্বাচিত বাদ দেওয়া: ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে কোনো সমালোচনা না থাকা বা কৌশলগত ভাবে ভারতের ভূমিকাকে 'অতিরঞ্জিত' করার প্রবণতা সম্ভবত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিশেষ ও ভালোভাবে তুলে ধরতে চেয়েছে। ভারতের একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা রয়েছে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের নায়ক হিসেবে চিত্রিত করার এবং এটি বাংলাদেশে ভারতীয় প্রভাব বজায় রাখার কৌশলের অংশ হতে পারে।
- তথ্য ফ্রেমিং: ভারতের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা নিয়ে কোনো সমালোচনা না থাকায়, এটি একটি পরিষ্কার ফ্রেমিং কৌশল। ভারতের যেকোনো নেতিবাচক ভূমিকা বাদ দিয়ে কেবল তাদের 'সহায়ক' হিসেবে দেখানো সফট প্রোপাগাণ্ডারই অংশ হতে পারে।
ভারতের ইতিহাস বিকৃতি: পরোক্ষ প্রচারণা কৌশল
ভারত নিজেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কৌশলগত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। যেমন, ভারতের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক এবং রাজনৈতিক সহায়তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু ভারত এটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কৌশলগত জয়লাভ করতে চেয়েছিল। ভারত তার এই অবস্থান বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ব্যবহার করে এবং বর্তমান লেখাটি সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ভারতের পাঠ্যপুস্তকেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি:
ভারতের স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। বিশেষত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় পাঠ্যপুস্তকে যেভাবেভউপস্থাপন করা হয়েছে তা অনেক ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ বা নিরপেক্ষ বলে বিবেচিত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সামরিক ও রাজনৈতিক সহায়তার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নায়কদের অবদান ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয়নি। এতে করে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের মূল গল্প আড়ালে পড়ে যায় বলে অনেকে মনে করেন। আবার কিছু পাঠ্যপুস্তকে আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের প্রেক্ষাপটে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ভারতের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যায়নকে প্রভাবিত করে। ভারতের গুন্ডে সিনেমার মাধ্যমে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে বোঝানো হয়েছিল। এছাড়া ভারতের ক্ষমতাসীন অনেক নেতাই নানা সময়ে বলেছেন ৭১-এ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয়েছে।
জেরিন হোসেন রহস্য:
গবেষক ও মিডিয়া কর্মী হিসেবে জেরিন হোসেন হয়তো তার কাজ ও ব্যক্তিগত পরিচয় গোপন রাখছেন। কিন্তু তার সম্পর্কে আরও জানানো দরকার ছিল পাঠকদের যা বাংলা ট্রিবিউন করেনি। জেরিন হোসেনের নাম উল্লেখ করা হতে পারে তার কাজের ও তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য। কোনো রাজনৈতিক বা কৌশলগত কারণে তার বাস্তব পরিচয়ের পরিবর্তে একটি কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করা হয়েছে কি না, সে বিষয়েও ভাবার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতীয় প্রভাব বৃদ্ধি
ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে ভারতের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব ধরে রাখা হলে:
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সমর্থন বাড়ানো: বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারত দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন দিয়ে আসছে। এই ধরনের প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভারতের ভূমিকা এবং পাকিস্তানবিরোধী বক্তব্যকে প্রাধান্য দেওয়া হলে, আওয়ামী লীগের অবস্থান মজবুত হয় এবং ভারত-আওয়ামী লীগ সম্পর্ক আরও জোরদার হয়।
বিরোধী দলকে দুর্বল করা: বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো, বিশেষত বিএনপি-জামায়াত, পাকিস্তানের বন্ধু বলে পরিচিত। প্রতিবেদনটি পাকিস্তানের নেতিবাচক দিক তুলে ধরলে, পরোক্ষভাবে তা বিরোধী দলগুলোর অবস্থানকে দুর্বল করে দেয়। ভারতের লক্ষ্য বাংলাদেশে এমন একটি সরকারকে ক্ষমতায় রাখা, যা ভারতের সঙ্গে কৌশলগত ও রাজনৈতিক সম্পর্ক মজবুত রাখবে। এ ধরনের প্রচারণা সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক।
সফট পাওয়ার ব্যবহার
ভারত দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় তার সফট পাওয়ার (সংস্কৃতি, ইতিহাস, এবং রাজনৈতিক প্রভাব) ব্যবহার করে আসছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভারতের ভূমিকা তুলে ধরে:
ভারতীয় সফট পাওয়ার বাড়ানো: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভারতের সহায়ক চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে ভারত তার সফট পাওয়ার কৌশলকে সফলভাবে কার্যকর করে। এ ধরনের রিপোর্টগুলো বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে ভারতের প্রতি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে এবং তাদের মনে ভারতকে একটি নির্ভরযোগ্য ও বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ভারত-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংযোগ: ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক সংযোগ মজবুত করতে, মুক্তিযুদ্ধকে একটি বিশেষ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে ভারতের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বড় অংশে নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
তবে এই লেখকের সম্পর্কে আমরা জানতে না পারলেও, বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক দাবি করেছে, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এই অনলাইনের একজন সিনিয়র নারী সংবাদকর্মীর লেখা চন্দন নন্দী, তরুন চক্রবর্তী, সঙিতা স্যানালসহ নানা ঘোস্ট সাংবাদিকদের নামে প্রচার করা হয়েছে। যেই নারী সংবাদকর্মীর আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা গ্রুপের সাথেও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
Two Comments