Crime And Corruption

একুশে টেলিভিশনের অভ্যন্তরে টিসিবি পণ্যের দুর্নীতির কালো অধ্যায়

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান, একুশে টেলিভিশন। অথচ, এই প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে একটি দুর্নীতির চক্র, যারা সাধারণ মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ন্যায্যমূল্যের পণ্য চুরি করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করে আসছে।  


এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে টিসিবি পণ্য নিয়ে একুশে টেলিভিশনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারময় দুর্নীতির গল্প, যেখানে নাম এসেছে সিনিয়র সাংবাদিক থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত অনেকের।  


প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, রেজা নামে এক রানার, যার কাজ ছিল অফিসের ফুটেজ টানা, পুরান ঢাকার ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে ‘সানি ট্রেডার্স’ নামে একটি লাইসেন্স সংগ্রহ করে টিসিবি পণ্যের কার্ড তৈরির মাধ্যমে এই দুর্নীতি শুরু করেন। রেজা একুশে টেলিভিশনের নাম ব্যবহার করে তার নির্ধারিত এলাকার কিছু মানুষের নামে কার্ড তৈরি করলেও, বাস্তবে তাদের পণ্য দেওয়া হতো না।  


রেজার অসাধু পরিকল্পনার সবচেয়ে ন্যক্কারজনক দিকটি হলো, একুশে টেলিভিশনের অনেক কর্মীর অজান্তে তাদের নাম ব্যবহার করে কার্ড তৈরি করা। এমনকি, যারা দীর্ঘদিন আগে দেশ ছেড়েছেন—মাহথির ফারুকী ও কনক সরোয়ার—তাদের নামেও কার্ড বানানো হয়েছে।  


রেজার পরিকল্পনা একা চালানো সম্ভব হয়নি। এই চক্রের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন একুশে টেলিভিশনের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন, সাংবাদিক প্রনব চক্রবর্তী , আকবর হোসেন সুমন আর মানিক শিকদার । এই দুর্নীতিতে সরাসরি সহযোগিতা করেছে, এবং টিসিবি পণ্য বিতরণে অংশ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির এইচআর হেড নাসিম হোসেন।  


টিসিবির এই কার্ডের পণ্য নিয়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারীতে টেলিভিশন স্টেশনটির নয় তলায় স্টুডিও ট্যকনিশিয়ান ও মেকাপ আর্টিস্টদের সাথে হাতাহাতিতেও জড়ায় রেজা। তখনও তাকে উদ্ধার করে প্রণব চক্রবর্তী ও নাসিম হোসেন। 


দুর্নীতি চক্রের অংশ হিসেবে টিসিবি পণ্য সরবরাহের পদ্ধতিটিও ছিল অত্যন্ত কৌশলী। পুরান ঢাকার একটি কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে এসব পণ্য বিভিন্ন জেলা শহরেও পাঠানো হতো বিক্রির জন্য। এ ছাড়া, পুরান ঢাকার একটি হোটেলে পাইকারি দামেও পণ্য বিক্রি করা হতো।  


ইটিভির ক্যান্টিনেও নিয়মিত এই পণ্য বিক্রি হতো। একুশে টেলিভিশনের গাড়ি ভোররাতে পুরান ঢাকা থেকে মাল নিয়ে আসত, যা পরবর্তীতে কর্মচারীদের মধ্যে ভাগ করা হতো।  


এখন প্রশ্ন হলো, রেজা কীভাবে এত বড় একটি দুর্নীতি চক্র গড়ে তুলতে সক্ষম হলো? অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, রেজা তার প্রভাব বিস্তার করতে টিসিবি পণ্য ব্যবহার করে বসদের ‘ম্যানেজ’ করতেন। এর ফলে, কেউ তার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস পেতেন না।  


সিনিয়র সাংবাদিক প্রণব চক্রবর্তী, আকবর হোসেন সুমন এবং মানিক শিকদার সরাসরি এই চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই অপকর্ম বছরের পর বছর ধরে চলেছে।


এই চক্রের জালিয়াতির মাধ্যমে করা কার্ডের মধ্যে আমরা সরাসরি পেয়েছি আরও বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মীর নাম। তারা হলেন,  কবির মিয়া,সাইফুল ইসলাম দিলাল, শাকেরা আরুজু, ভিডিও জার্নালিস্ট আলি আহমেদ রুবেল,মনিরুজ্জামান মনিসহ বিভিন্ন পোস্টের প্রায় সব কর্মকর্তা।


টিসিবি পণ্য সাধারণ মানুষের জন্য বরাদ্দ করা হয়, যাতে তারা ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে পারেন। কিন্তু, এই চক্রের কারণে সেই পণ্য সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছায়নি। বরং তা হয়ে উঠেছে একুশে টেলিভিশনের অভ্যন্তরে দুর্নীতির হাতিয়ার।  


পুরান ঢাকার একজন বাসিন্দা যার নামেও কার্ড করা হয়েছে তিনি জানান, “কোনো পণ্য পাইনি। অথচ শুনেছি, এসব পণ্য ভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।”  



একুশে টেলিভিশনের এই দুর্নীতি প্রশ্ন তোলে টিসিবি এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতার ওপর। কিভাবে এতদিন ধরে টিসিবি পণ্য চুরি হয়ে আসছিল, অথচ কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? এই প্রতিবেদন সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য একটি বার্তা দেয়। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে।  


দাবি:  

১. অবিলম্বে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা হোক।  

২. এই চক্রের সাথে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।  

৩. টিসিবি পণ্য বিতরণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি নির্ভর নতুন পদ্ধতি চালু করা হোক।  


সাধারণ মানুষকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হলে প্রশাসন এবং টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে তাদের ভূমিকা নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।


ইটিভি/টিসিবি


  • Previous Post

    ইটিভির সাংবাদিক নেতাই স্টেশনটির কর্মীদের আতংক

Two Comments

আপনারও পছন্দ হতে পারে<

শেখ হাসিনার স্নেহের অভির ভয়ংকর অর্থ কেলেঙ্কারি

এই কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও এই প্রকল্প থেকে নিয়েছেন ৫ কোটি টাকা। কিন্তু মানহীন এই কাজে খরচ ৫ ভাগের এক ভাগও নয়।

একুশে টেলিভিশনের অভ্যন্তরে টিসিবি পণ্যের দুর্নীতির কালো অধ্যায়

এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে টিসিবি পণ্য নিয়ে একুশে টেলিভিশনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারময় দুর্নীতির গল্প, যেখানে নাম এসেছে সিনিয়র সাংবাদিক থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত অনেকের।

ইটিভির সাংবাদিক নেতাই স্টেশনটির কর্মীদের আতংক

অতীতে অভিযোগ করতে ভয় পেলেও এবার দ্বিতীয়বার যোগ দেয়া চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের কাছে লিখিত ২ পাতার বিশাল অভিযোগ জানিয়েছে জেলা প্রতিনিধিরা।

মতামত দিন