বিএমএম ডেস্ক: "
এস আলম গ্রুপকে সরকারের সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন" শিরোনামের একটি সংবাদ বার্তা২৪ প্রকাশ করেছে। এটি আসলে কৌশলগতভাবে কর্পোরেট প্রোপাগাণ্ডার একটি শক্তিশালী উদাহরণ হতে পারে। শিরোনামটি সরাসরি রাষ্ট্রের সাহায্য চাওয়ার মাধ্যমে কর্পোরেট গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার দিকে ইঙ্গিত করে। আসুন এই শিরোনামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক বিশ্লেষণ করা যাক:
শিরোনামে সরকারকে সরাসরি প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা:
শিরোনামটিতে "সরকারের সহযোগিতা" চাওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এস আলম গ্রুপ তাদের কার্যক্রমকে চালিয়ে যেতে সরকারী সহায়তা প্রয়োজন বলে দাবি করছে। এটি কৌশলগতভাবে কর্পোরেট স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার একটি মাধ্যম। সাধারণত, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের অর্থনৈতিক, নীতিগত বা প্রশাসনিক সহায়তার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থে সুবিধা নিতে চায়।
সিমপ্যাথি (সহানুভূতি) কৌশল:
শিরোনামটি সাধারণ পাঠকের মধ্যে এস আলম গ্রুপের প্রতি সহানুভূতি জাগাতে পারে, যেন এটি একটি প্রতিষ্ঠান যা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং তার টিকে থাকার জন্য সরকারের সহযোগিতা অপরিহার্য। এটি জনগণের মনোভাবকে কর্পোরেট গোষ্ঠীর প্রতি ইতিবাচক করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। যদিও বাস্তবে, এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তবুও শিরোনামটি সেসব অভিযোগকে আড়াল করে একটি ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
রাষ্ট্র ও কর্পোরেট সংযোগের বৈধতা প্রতিষ্ঠা
"সরকারের সহযোগিতা" চাওয়ার মাধ্যমে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করা হয় যে, রাষ্ট্র এবং বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। এটি কর্পোরেট প্রভাবকে বৈধতা দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা, যেখানে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর সাথে সরকারের সম্পর্ককে সুশাসনের একটি অংশ হিসেবে দেখানো হয়। এ ধরনের ধারণা মূলত গণতান্ত্রিক নীতিমালা এবং বাজারের স্বচ্ছতা ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
নৈতিক দায়িত্ব এড়ানোর প্রচেষ্টা:
এই ধরনের শিরোনাম, যেখানে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সরকারী সহযোগিতা চায়, তা প্রায়শই তাদের নৈতিক ও আর্থিক দায়িত্ব থেকে রেহাই পাওয়ার একটি উপায় হতে পারে। এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে থাকা অনিয়মের অভিযোগগুলো যেমন অর্থ পাচার, ব্যাংক লুটপাট ইত্যাদি আলোচনা না করে, বরং সহযোগিতা চাওয়া একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ যা মূল সমস্যাগুলো আড়াল করে রাখে।
বার্তা২৪ কেন এমন সংবাদ প্রকাশ করেছে?
বার্তা২৪, যেহেতু এস আলম গ্রুপের অর্থায়নে চলে, এই সংবাদ প্রকাশ করা এক ধরনের কর্পোরেট প্রভাবের স্পষ্ট উদাহরণ। সংবাদমাধ্যমটি কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায় সরাসরি অংশগ্রহণ করছে। কারণগুলো হতে পারে:
-
অর্থনৈতিক সুবিধা: কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যখন কোনো সংবাদমাধ্যমে অর্থায়ন করে, তখন সেই সংবাদমাধ্যমটি নিরপেক্ষভাবে সংবাদ প্রচারের ক্ষমতা হারায় এবং প্রায়শই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। এস আলম গ্রুপের অর্থায়ন এই ধরনের সংবাদ প্রকাশ করার পেছনে মূল চালিকা শক্তি হতে পারে।
- কর্পোরেট প্রচারণা চালানো: কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে এবং যেকোনো নেতিবাচক ইমেজ এড়াতে সচেষ্ট থাকে। এই সংবাদটি এস আলম গ্রুপের জন্য একটি ইতিবাচক প্রচারণা তৈরি করতে সাহায্য করছে, যাতে তারা সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে একটি বৈধতা লাভ করতে পারে।
- জনসাধারণের সমর্থন পাওয়া: এমন সংবাদ জনসাধারণের মাঝে এস আলম গ্রুপকে দেশের জন্য একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালায়। সাধারণ মানুষ যাতে মনে করে যে, এস আলম গ্রুপের অস্তিত্ব দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেই উদ্দেশ্যে সংবাদটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর কৌশল:
এই ধরনের সংবাদে কয়েকটি প্রধান প্রোপাগাণ্ডা কৌশল ব্যবহার করা হয় যা জনগণের মনে প্রভাব ফেলতে সহায়ক:
- আখ্যান গঠন: পুরো সংবাদটির আখ্যান এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে এস আলম গ্রুপের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হয় এবং তাদের সমস্যাকে একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এটি পাঠকের মনে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে।
- সরলীকরণ: পুরো জটিল পরিস্থিতিকে অতি সরলীকৃত আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রচুর অনিয়মের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র "সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন" বলে দাবি করে এই সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
- নির্বাচিত তথ্য বর্জন: এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে থাকা ব্যাংক লুটপাট, অর্থ পাচার, এবং অন্যান্য গুরুতর অভিযোগগুলো সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। সংবাদটি একদমই পক্ষপাতদুষ্ট এবং শুধু ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
- কর্তৃত্বের প্রতি আবেদন: সরকারের সহযোগিতা চাওয়া মানেই হলো সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা রাখা এবং সরকারকে একটি নৈতিক অবস্থানে দাঁড় করানো। এতে করে পাঠক মনে করতে পারে যে, সরকারের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান আসতে পারে, যদিও প্রকৃতপক্ষে এটি একটি কর্পোরেট চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টা।
এস আলম গ্রুপের পক্ষে যেসব প্রোপাগাণ্ডা চালানো হয়, সেগুলোতে নিম্নোক্ত কৌশলগুলো লক্ষ্য করা যায়:
চট্টগ্রাম সুপ্রেম্যাসি প্রতিষ্ঠা: দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়িক শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রভাবশালী অবস্থানকে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়। এটি দেশের অভ্যন্তরে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং জাতীয় ঐক্যকে দুর্বল করে।
ব্যবসায়িক সাফল্যের অতিরঞ্জন: এস আলম গ্রুপের সফলতা এবং অর্থনৈতিক অবদানকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হয়, যা তাদের পক্ষে সমর্থন জোগাতে জনগণের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
অভিযোগগুলোর ন্যায্যতা প্রমাণের চেষ্টা: ব্যাংক লুটপাট, অর্থ পাচার ইত্যাদির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো নিয়ে তেমন কোনো তথ্য উপস্থাপন করা হয় না বা ধামাচাপা দেওয়া হয়। বরং, তাদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
এস আলম গ্রুপের মতো প্রভাবশালী কর্পোরেট গোষ্ঠী গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে ব্যবসায়িক স্বার্থে একটি বিশেষ মডেল তৈরি করে থাকে। এই মডেলটির মূল উপাদান হলো:
গণমাধ্যমে অর্থায়ন করা: কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলো সংবাদমাধ্যমে অর্থায়ন করে তাদের আখ্যান তৈরি করতে সহায়তা করে।
লেখকদের অজ্ঞাত রাখা: ঘোস্ট রাইটার ব্যবহার করে আখ্যান তৈরি করা হয়, যা তাদের স্বার্থরক্ষার কৌশল হিসেবে কাজ করে।
নেতিবাচক তথ্য ধামাচাপা দেওয়া: কর্পোরেট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে থাকা গুরুতর অভিযোগগুলো সম্পর্কে জনসাধারণের কাছে সঠিক তথ্য না পৌঁছানোর জন্য সংবাদকে সুকৌশলে ম্যানিপুলেট করা হয়।
কিভাবে প্রোপাগাণ্ডা ছড়াচ্ছে?
এই ধরনের সংবাদ গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর কার্যকর মাধ্যম। মূল বিষয়গুলো হলো:
জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা: সাধারণ পাঠক এই সংবাদ পড়ে সহজেই মনে করতে পারে যে, এস আলম গ্রুপ দেশের জন্য অপরিহার্য এবং তাদের সহযোগিতা না করলে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাস্তবে, এটি এস আলম গ্রুপের স্বার্থ রক্ষা করার একটি প্রচেষ্টা মাত্র।
কর্পোরেট অপরাধ আড়াল করা: এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে থাকা গুরুতর অভিযোগগুলোকে আড়াল করার জন্যই মূলত এই ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জনগণের সামনে নিজেদেরকে একটি ভালো অবস্থানে উপস্থাপন করতে চায়, যাতে তারা জনমতের সহানুভূতি লাভ করতে পারে।
সামাজিক বিভাজন তৈরি: চট্টগ্রাম ভিত্তিক এই গ্রুপ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি করতে সাহায্য করছে। এর ফলে জাতীয় সংহতি দুর্বল হতে পারে এবং দেশের ভেতরে আঞ্চলিক বিভেদ বাড়তে পারে।
বার্তা২৪-এর ভূমিকা:
বার্তা২৪-এর ভূমিকা এই সংবাদে সরাসরি প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার আদর্শ থেকে সরে এসে কর্পোরেট স্বার্থকে রক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এস আলম গ্রুপের মতো একটি বিতর্কিত কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পক্ষের সংবাদ প্রকাশ করে, তারা প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতার নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সমাজ ও দেশের ওপর প্রভাব:
এই ধরনের প্রোপাগাণ্ডা সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। এটি দেশে বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর প্রভাবকে বাড়িয়ে তোলে এবং তাদের অপকর্মগুলো আড়াল করতে সহায়তা করে। এতে সুশাসনের অবক্ষয় ঘটে, এবং সাধারণ জনগণ সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হয়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের অপকর্ম এবং ব্যাংক লুটপাটের মতো বিষয়গুলো আড়ালে থেকে যায়, যা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সাধারণ জনগণের আস্থা নষ্ট করে।
"এস আলম গ্রুপকে সরকারের সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন" শিরোনামের সংবাদটি সরাসরি কর্পোরেট প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর একটি কৌশল হিসেবে কাজ করছে। বার্তা২৪-এর মতো সংবাদমাধ্যমগুলো কর্পোরেট প্রভাবের কারণে সত্যিকার সাংবাদিকতা থেকে সরে এসে বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করছে। এই ধরনের সংবাদ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর এবং জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতে সহায়ক।
Two Comments