বাংলাদেশে ৪৫ টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল,২৮ টি এফএম এবং ৩২ টি কমিউনিটি রেডিও স্টেশন, ১২৪৮টি দৈনিক সংবাদপত্র এবং অগনিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল রয়েছে। কর্পোরেট গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি অনলাইন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে মিডিয়া শিল্পের মূল্য ২৭ বিলিয়ন টাকা (২০১৬) বার্ষিক বৃদ্ধির হার ১০-১২ শতাংশ। তবে এই বিশাল আর্থিক লেনদেন বা অর্থ উৎপাদনের সাথে মিডিয়ার সংযুক্তি থাকার পরও খুব কম সংখ্যক মিডিয়া হাউজ কোন রকমের সংকট ছাড়াই অতীতে চলেছে বা চলছে।
এই আলোচনা আরও দীর্ঘ করা যেতে পারে। তবে একটু অন্যদিকে নজর দিয়ে আলোচনা সামনের দিকে নিয়ে যেতে চাই আমরা। এই যে সংখ্যার দিক দিয়ে ব্যাপক পরিমাণে টিভি চ্যানেল,রেডিও আর অনলাইন পোর্টাল গুলো আসলে পরিচালনা করে কারা,বা প্রতিষ্ঠান গুলোর পিছনে আসলে কারা দাড়িয়ে আছে বা সোজা কথা বলতে এর মালিক কারা- এটা একটা গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর মালিকানা তথ্য পর্যালোচনা করলে তিনিটি বিষয় পরিষ্কারভাবে পাওয়া যায়। (১) পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রীত। (২) মালিক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। (৩) প্রায় সব মিডিয়া আউটলেট বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মালিকানাধীন।
বাংলাদেশের বেসরকারি টিভির লাইসেন্স দেয়া ও মালিকানার তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, সব সময়ই লাইসেন্স দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। অথবা লাইসেন্স রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হলেও পরে যখন তা অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, সেখানেও বিবেচনা করা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে। আর এই হস্তান্তরের সময় সঠিক রাজনৈতিক ব্যক্তির হাতে পড়ছে কিনা সেটা যাচাই-বাছাই করে মূলত দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
মিডিয়ার মালিকানা কতটা শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তার কয়েকটি উদাহরণ হলো, পাঁচটি টেলিভিশন চ্যানেলের সরাসরি মালিক বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের এমপিরা। তারা হলেন মোরশেদ আলম (আরটিভি), গোলাম দস্তগীর গাজী (গাজী টিভি), কামাল আহমেদ মজুমদার (মোহনা টিভি), সালমা ইসলাম (যমুনা টিভি) ও শাহরিয়ার আলম (দুরন্ত টিভি)। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত সালমান এফ রহমান একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির মালিক।

বেসরকারি টেলিভিশনকে লাইসেন্স দেয়া শুরু হয় ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ আমলে। সে সময় ৪টি লাইসেন্স প্রদান করা হয়। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এসে ৫টি লাইসেন্স দেয়। সবচেয়ে বেশি লাইসেন্স দেয়া হয় ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সেই টার্মে আওয়ামী লীগ টেলিভিশন লাইসেন্সকে 'মাছের বাজারে' রূপ দেয়। একসাথে ২৯টি টিভির লাইসেন্স ছাড় দেয়। এর পরের টার্মেও ৭টি টেলিভিশনের লাইসেন্স দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
তিন টার্মে আওয়ামী লীগ দেশে ৪০টি টেলিভিশনকে লাইসেন্স দেয় আর এক টার্মে বিএনপি ৫টি টেলিভিশনের লাইসেন্স দেয়। সবগুলো লাইসেন্সই দেয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। এগুলো পেয়েছে হয় রাজনৈতিক নেতা বা এমপি অথবা দুই দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা।
আমরা যদি ফিরে যাই ১৯৯৯ সালের দিকে। তখন দেখতে পাই, সাজ্জাত আলী সে সময় টেন টিভি নামে একটি টেলিভিশনের লাইসেন্স পান। এরপর বিএনপি আমলে ২০০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি লাইসেন্সটি কিনে নেয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী। এরপর এর নামকরণ করা হয় NTV. আবার বিএনপির সাংসদ মুশফিকুর রহমান উপহার হিসেবে Desh Tv এর লাইসেন্স পান। পরে সরকার পরিবর্তন হলে দেখা যায়, বেশিরভাগ শেয়ার কিনে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সাবের হোসেন চৌধুরী।
টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের সমিতির (ATCO) বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, সরকারের সমালোচনা করা মিডিয়া আউটলেটগুলি তাদের রাজস্ব হারানোর ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হয় এই সংগঠনের জন্য। কারণ সরকারী সংস্থাগুলি বেসরকারী সংস্থাগুলিকে এই মিডিয়াগুলিতে বিজ্ঞাপন না দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। আর যা পর্দার আড়ালে বসে এই সংগঠনই নিয়ন্ত্রণ করে। এই সংগঠনই বাংলাদেশের টেলিভিশন গণমাধ্যমে'সেলফ সেন্সরশিপ' তৈরি করেছে।
২০০৭-২০০৮ সালে সামরিক-সমর্থিত সরকারের সময় মিডিয়া বিষয়বস্তু এবং সংবাদের পরিবর্তন-পরিমার্জনের জন্য সরকারি সংস্থাগুলির সরাসরি হস্তক্ষেপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মজার ব্যাপার হল, মিডিয়া মালিকরা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যুক্ত হতে সব সময়-ই ইচ্ছুক ছিল। একটি খসড়াতে 'বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা নীতি ২০১২ ' প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেখানে বলা হয় রাজনৈতিক দল এবং তাদের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানা নিষিদ্ধ করা হবে। যা তৎকালীন এটিসিও-এর সভাপতি এবং প্রাক্তন বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালু বিরোধীতা করেছিলেন। সে সময় তিনি যুক্তি দেখান যে, মিডিয়া সেক্টরে গত এক দশকে প্রচুর অর্জন হয়েছে এবং সরকারের সহায়ক নীতি হিসেবে নতুন মিডিয়া আউটলেট তৈরি করতে সাহায্য করেছে।
এই প্রবণতা প্রিন্ট মিডিয়ার ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। আর এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে স্যাটেলাইট। তবে প্রতিদিন মিডিয়া হাউজ বাড়লেও সংবাদের মান বাড়ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সংবাদের নির্ভরযোগ্যতা তথ্য প্রদানকারীর বিশ্বাসযোগ্যতার উপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশে মিডিয়া কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, সময়ের সাথে সাথে কীভাবে এর মালিকানা পরিবর্তিত হয়েছে এবং মিডিয়া আউটলেটের মালিকরা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির সাথে কতটা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত তা বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ।
সংবাদ প্রদানকারীর সংখ্যা বাড়লেও, তা নিয়ন্ত্রণের প্রবণতাও বাড়ছে। আর মালিক যখন নিজেই রাজনৈতিকভাবে আশীর্বাদপুষ্ট হয় তখন তার প্রতিষ্ঠান এমনিতেই সত্য সংবাদটি চেপে যান।
Two Comments