Free Press

সাংবাদিক নাদিম হত্যা: আসামিরা নিরাপদ, অনিরাপদে পরিবার

জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় গত ১৪ জুন আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল আলম বাবুর নির্দেশে সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২২ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হলেও মামলার তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বেশ কয়েকজন আসামিকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এদিকে, নাদিমের পরিবার এখনো ভয়ভীতি এবং হুমকির মুখে দিন কাটাচ্ছে। গোলাম রাব্বানী নাদিমের হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছেন বকশীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু, যিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে সাংবাদিক নাদিম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যেখানে বাবুর দ্বিতীয় বিবাহের খবর এবং স্থানীয় দুর্নীতি নিয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে বাবু, তার সহযোগী এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের নিয়ে নাদিমের ওপর হামলা চালান। মাহমুদুল আলম বাবুর আরও একটি পরিচয় তার কথিত চাচাতো ভাই, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান পান্না। বাবুর রাজনৈতিক শক্তি এবং পান্নার প্রভাবের কারণে মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ায় বারবার বাধা দেওয়া হয়। ২৭ আগস্ট দাখিল করা চার্জশিটে ২২ জন আসামির মধ্যে ১৬ জনের নাম বাদ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, মূল আসামি বাবুর ছেলে ফাহিম ফয়সাল রিফাত, যিনি বকশীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক, তাকেও চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নাদিমের মেয়ে রাব্বিলাতুল জান্নাত জানান, আমার বাবা হত্যার বিচার চাইতে গেলে আমাদের পরিবারকেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। বাবার হত্যাকাণ্ডের পর আমরা সবসময় আতঙ্কে থাকি। আমাদেরকে মামলা করতে পর্যন্ত বাধা দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ৬ জুলাই আমাদের বাসায় ঢুকে হামলার চেষ্টা করে ৭ নম্বর আসামি সুমনের স্ত্রী। তার লোকজন বাসায় ঢোকার পর আমরা চরম আতঙ্কে ছিলাম। পুলিশকে জানালে তারা এসে তাকে আটক করে। কিন্তু এসব হুমকি আমাদের জীবনকে আরও অনিরাপদ করে তুলছে। গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যার পর মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে বকশীগঞ্জ থানা পুলিশ, পরে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং সবশেষে সিআইডি। তবে মামলার অগ্রগতিতে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে বলে অভিযোগ। নাদিমের পরিবার দাবি করেছে, তদন্ত কর্মকর্তারা বারবার পরিবর্তিত হয়েছেন এবং রাজনৈতিক নির্দেশনায় চার্জশিট দুর্বল করা হয়েছে। সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিরা এখনো আইনের আওতার বাইরে থাকায় তার পরিবার সবসময় আতঙ্কে বসবাস করছে। নাদিমের মেয়ে রাব্বিলাতুল জান্নাত আরও বলেন, 'আমরা এখনো সঠিক বিচার পাইনি। যারা বাবাকে হত্যা করেছে, তাদের অনেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মুক্ত রয়েছে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছি। নাদিম কন্যা জানান, চার্জশিট থেকে ৭ নং আসামির সিসি ফুটেজে ছবি থাকা সত্ত্বেও তাকে বাদ দেওয়া হয়। অজ্ঞাত আসামী নয়ন নামে একজন স্বীকারোক্তি দিলেও তাকেও চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয়। এসব আসামী এখন আমাদের নিয়মিত নানাভাবেই ভয়-ভীতি দেখিয়ে যাচ্ছে। নাদিম হত্যা নিয়ে আমাদের অনুসন্ধান বলছে, এই হত্যায় জড়িত রয়েছেন স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহিনা ও সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বাবুল তালুকদার। আর এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতেন জামালপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। তার আশকারাতেই কয়েকবার নাদিমকে হত্যার চেষ্টা করে শাহিনা-বাবুলরা। যার পর জীবন নিয়ে শঙ্কার কথাও জানিয়েছিলেন নাদিম। নাদিমকে হত্যার কয়েকদিন আগেও ১৪ এপ্রিল উপজেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় নাদিমকে হত্যা বা শায়েস্তা করতে এক মিনিট সময় লাগবে বলে জানায় উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। আর সেই সভা থেকে চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুকে হুকুম দেয়া হয় নাদিমকে শায়েস্তা করার। এরপর ঠিকই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের হুকুম পালন করে চেয়ারম্যান বাবু। হত্যা করে সাংবাদিক নাদিমকে। এই কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেয়া শাহিনা-বাবুলরা ক্যাডার বাহিনী। যা ৬ জুনের হত্যাকান্ডের সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যায়। নেয়া শাহিনা-বাবুলরা ক্যাডাররা এর আগেও হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করেছিল নাদিমের উপর। নাদিমের হত্যার পর শাহিনা মানসিক নির্যাতন শুরু করেছিলো নাদিমের পরিবারের উপর। এমনকি মামলা দিতে গেলে সাংবাদিক নাদিমের স্ত্রীকে চাকরিচ্যুত করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ভয়-ভীতিও দেখান। যা এখনও চলমান আরও ভয়ংকরভাবে। এই ঘটনায় শাহিনা ছাড়াও যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল তালুকদার সরাসরি জড়িত তার প্রমাণ মেলে নাদিম হত্যার পর সাংবাদিক নেতাদের ২০ জুলাই ২০২৩ এ বকসীগঞ্জে উপস্থিতির দিন। সেদিন স্থানীয় সাংবাদিকরা বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেন। সেই সমাবেশে এক প্রকার জোর করেই হাজির হোন সাংসদ আবুল কালাম আজাদ। তার চেয়েও অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হাজির হোন বাবুল তালুকদারের ভাই এবং বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত বকশীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান রউফ তালুকদার। মঞ্চে উঠে তিনি সাংবাদিক নেতা এবং সাংসদের সামনেই স্থানীয় সাংবাদিকদের মাইকে হুমকি ও ধমক দেন। মঞ্চে এসময় নির্বিকার বসে থাকেন ওমর ফারুক, মনজুরুল আহসান বুলবুলসহ অন্যান্য সাংবাদিকরা। এই অনুষ্ঠানে সাংবাদিক নেতারা বলেন, আবুল কালাম আজাদ সাহেব তাদের খুব প্রিয় মানুষ । তিনি প্রেসক্লাবে গিয়ে আড্ডা দেন। তবে তিনি দায়ী থাকলে তার বিরুদ্ধেও বলবেন। কিন্তু সেই বলা, বলা পর্যন্তই আজ পর্যন্ত হয়নি কোন সুরাহা। নাদিম হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা বিচারহীনতার চিত্র স্পষ্ট করে তুলেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব এতটাই প্রবল যে, মামলা তদন্তে সঠিকভাবে অগ্রগতি হয়নি। নাদিমের পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, অথচ অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে নিরাপদ। আওয়ামী লীগ সুরকার পালিয়ে গেলেও, তাদের জায়গা আসা ইউনুস সরকারও সাংবাদিকদের হত্যা-নির্যাতন নিয়ে উদাসীন। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে সাংবাদিকদের এসব সংকট নিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তার পক্ষ থেকে কোন রেসপন্স পাওয়া যায় না। এই হত্যাকাণ্ডটি শুধু নাদিমের পরিবারের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্যও একটি কালো অধ্যায়। এ ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে যে, দুর্নীতি ও ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে কথা বলার মূল্য হতে পারে 'জীবন'। এদিকে সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যাকাণ্ডের পর সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নীরবতা একটি উদ্বেগজনক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত ও বিচার দাবিতে কিছু সংগঠন প্রথম দিকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, তবে পরবর্তীতে তা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সাংবাদিকরা নিজেরাও এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত। নাদিমের হত্যাকাণ্ডের পর যারা তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন, তাদের অনেকেই হুমকির মুখে পড়েছেন। ফলে সাংবাদিক সমাজের মধ্যে একটি নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আবার বাংলাদেশে সাংবাদিক সংগঠনগুলো রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে বিভক্ত। বিভিন্ন সংগঠন নিজ নিজ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করে থাকে। ফলে একক কোনো সংগঠনও শক্তিশালীভাবে নাদিম হত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেনি। কিছু সাংবাদিক সংগঠন ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে। এসব নেতাদের বিরুদ্ধাচরণ করলে তাদের সংগঠন এবং ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ফলে, তারা প্রকাশ্যে নাদিম হত্যার প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছেন না। একই অবস্থা ঢাকার বেশিরভাগ গণমাধ্যমেরও। গোলাম রাব্বানী নাদিমের হত্যাকাণ্ড শুধু একটি ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা ছিল না; এটি দেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের আরেকটি উদাহরণ। এই মামলা যদি সঠিকভাবে তদন্ত এবং বিচার না হয়, তাহলে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা আরও বেশি বিপদের সম্মুখীন হবেন। নাদিমের পরিবার শুধু তাদের প্রিয়জনকে হারায়নি, তারা হারিয়েছে নিরাপদ জীবনযাপনের অধিকারও। এই পরিবারের সংগ্রাম এবং আতঙ্কের জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বিচারহীনতার এই চক্র ভাঙা না গেলে, আমরা আরও অনেক নাদিমকে হারাবো।  
  • Previous Post

    প্রেস এক্সপ্রেসের পেছনের কারিগর শেখ মুবিন

Two Comments

আপনারও পছন্দ হতে পারে<

চা শ্রমিকদের চেয়েও কম বেতন দেয় ঢাকার কিছু গণমাধ্যম

গণমাধ্যমের এই প্রতিটি শাখাতেই বেতন বৈষম্যের পাশাপাশি রয়েছে আরেকটি ভয়ংকর দিক, তা হলো বেতন বৃদ্ধি না হওয়া। কোথাও কোথাও তো বেতন বৃদ্ধি হয় না বহু বছর। আবার কোথাও কোথাও হলেও তা নামমাত্র 'ইনক্রিমেন্ট'।

চাঁদ রাতে সারাবাংলার 'ব্যতিক্রমী' ঈদ বোনাস: জেলা প্রতিনিধিদের বোনাস চাওয়ায় চাকরিচ্যুত

এমন সিদ্ধান্তকে অনেকেই ব্যঙ্গ করে বলছেন—এটাই সারাবাংলার 'ব্যতিক্রমী ঈদ বোনাস।

অসোন্তষ ছড়িয়েছে জেমকন গ্রুপের ঢাকা ট্রিবিউনে

এদিকে, কর্মীদের শান্ত করতে আগামী রোববার বিশেষ সভা আহ্বান করেন বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যর্থ, সম্পাদক জাফর সোবহান।

মতামত দিন